দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত তেঁতুলিয়ার সনাতন ঢুলি সম্প্রদায়
1 min read![](http://vorerjanala.com/wp-content/uploads/2024/01/8630260142469497704_n-1024x473.jpg)
![](http://vorerjanala.com/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
মুস্তাক আহমেদ, পঞ্চগড় প্রতিনিধি
দেশের দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি ও বর্তমান অর্থসংকট প্রেক্ষাপটের করুণ চিত্র ফুটে উঠে গ্রামীন আর্থসামাজিক ব্যবস্থায়। বাঙ্গালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও দুর্বলতার জায়গা গ্রামীন ঢুলি ও ঢাকের তালে মননানন্দ । সেই মহানন্দের জায়গায় আজ দারিদ্রের ছায়া। ঢুলি শিল্পিরা বেচে থাকার তাগিদে পেশা বদলে হয়েছে সৌন্দর্যহীন কর্মকার।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের কালিয়ামণিগ্রাম । এখানে থাকে একদল সনাতন ঢুলি সম্প্রদায়ের দল। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে এদের ডাকা হতো বেশ ঘটা করে। আনন্দ র্যালি, বিবাহ অনুষ্ঠানে বরযাত্রী, আনন্দ মিছিল সহ গ্রামীন সমস্ত আনন্দ অনুষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছে এই ঢুলি সম্প্রদায়ের আত্মার টান। কিন্তু সেই আত্মারটানে আজ চিবুক ধরতে শুরু করেছে বেচে থাকার আত্মর্নাত ।
প্রায় ২০ শতক জমির উপর বাস করছে ঢুলি সম্প্রদায়ের ২০টিরও অধিক পরিবার। অভাব অনটনে আর দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত ঢুলি পল্লীর শতাধিক সদস্য। একবেলা খেতে পারেনা ঠিকমত । তীব্র শীতে জরাজীর্ণ ঢুলি পল্লীর শিশু থেকে বয়স্করা আছে কষ্টে। নেই শীতের কাপড় নেই কম্বল। আগের মত আর আচার অনুষ্ঠানে ডাক পড়েনা তাদের। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ও ডিজিটাল মিডিয়ার বদলে পাল্টে গেছে তাদের চিরচেনা সৌন্দর্য । আধুনিক হতে না পেরে বর্তমানে পেশাহীন জীবন যাপন করছে আনন্দলোকের মুর্তমান সেনারা। পরিবারকে বাঁচাতে তারা বেছে নিয়েছে ভিন্ন পথ। চড়া সুদে লোন নিয়ে ভেনচালিয়ে, মাছধরে, কিংবা পাথর শ্রমিকের কাজ করে পোহাতে হচ্ছে নিদারুন জীবন যাপন। হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পির চর্চা । হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকঢোলের শব্দ।
একসময় এই ঢুলিপ্ল্লীর ঢুলির আওয়ার শুনে দশগ্রামের শিশুসহ সব বয়সী মানুষেরা ভীড় করতো ঢুলি পল্লীতে। ঢাকের ছন্দে ছন্দে নাচতো ঢুলির কোমর । সেই আনন্দে গ্রামের সব সয়সী মানুষেরা যে আনন্দ পেত সেই আনন্দ আজ মৃম্হমান। যেন হারিয়ে গেছে সেই আনন্দের হাততালি সেই খুশি, সেই উল্লাস। পূজা পর্বণ সহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ঢাকের আওয়াজ না থাকলে যেন মাটি হয় যেত সব।
নীরেন্দ্রনাথ একজন স্কুল শিক্ষক । র্দীঘ দিন থেকে ঢুলির গান সহ বিভিন্ন র্কীতনের আয়োজনে যার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের র্কীতন অনুষ্ঠানে নীরেন্দ্রনাথের দেহত্বত্তের র্কীতন না শুনে শ্রোতারা উঠতেন না। জোৎস্নার আলোয় র্কীতন অনুষ্ঠান আয়োজকের বাড়িতে যেন মহুমহু করতালের ছন্দ। ধুপের ধোয়ার আর ঢুলিরদের সাদা পোষাকে তালনৃত্যের ছন্দ, ঢাক আর কাশির শব্দে মনপাগল ছন্দে ও নৃত্যে ভাসিয়ে নিত দর্শকের আনন্দলোকে। সেই আনন্দ আজ কোথায়। সেই ঢুলিরা আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ভ্যানের প্যাডেলে , জেলে সেজে নদীর কিনারে কিনারে, আর পাথর শ্রমিক হয়ে হাটে মাঠে ঘাটে।
নীরেনদ্রনাথ বলেন আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঢুলির শব্দ ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমরা যান্ত্রিক আনন্দের ছলনায় রুচিহীনের মত অসুস্থ হয়ে পড়বো। এখন যেমন আমাদের কোন কিছু শুনতে ভাল লাগেনা। কেমন যেন হয়ে গেছি আমরা। আমরা আমাদের শিকড়কে হারিয়ে ফেলেছি। সরকারের উচিত এই ঢুলি সম্প্রদায়কে বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বাচিয়ে রাখা। আমরা চাই নির্মল আনন্দ।
প্রায় শতবছরের পুরোনো ভিটায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠা নিজেদের মধ্যে ঢাক- ঢোল, কাশি- বাশির বাদক ও তাদের সম্প্রদায়। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা সরকারের বিভিন্ন সুবিধার বেষ্টনির মধ্যে আনতে চেষ্টা করেছিলেন। চেয়েছিলেন তাদের পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ঢুলি সম্প্রদায়ের কেউই চায়নি বাপ দাদাদের ভিটামাটি ছেড়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে। তারা চেয়েছিল সরকার যদি তাদের সম্প্রদায়টিকে ঢুলি পল্লীর নাম করণ করিয়ে আমাদের ভিটায় সরকারের দেয়া উপহারের ঘর বানিয়ে দিত তাহলে তারা বাপ দাদাদের ভিটায় থেকে নিজস্ব চর্চা সহ জীবন যাপন করতে পারতো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমি ফারজানা বলেন, ঢুলি পল্লীর সদস্যদের আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ঘর বরাদ্দ দিলে তারা প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘর পাবেন ঠিকই কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্ন করা হবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একটি চর্চার জায়গা । তারা একসাথে থাকতে না পারলে হারিয়ে যাবে তাদের অভ্যাস।
স্থানীয় সমাজ সেবক শেখ ফরিদ বলেন আমরা বিভিন্ন সময় ঢুলি পল্লীর পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করি । কিন্তু সরকার যদি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে সহযোগিতা করে তাহলে তারা ঘুরে দাড়াবে। পাশাপাশি সমাজের উচ্চবিত্তদের এগিয়ে আসতে হবে।
পঞ্চগড়ের প্রাণ প্রকৃতি –সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কারিগরের নির্বাহী পরিচালক সরকার হায়দার বলেন আমরা করোনার সময় ঢুলি পল্লীর ঢুলি সম্প্রদায়ে সুরক্ষা ও জীবন নির্বাহের বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছি। আমরা তাদের জীবন ও সামাজিক ভাবে তাদের অবস্থান নিয়ে একটি প্রতিবেদনও তৈরী করেছি । আমরা যতটুকু বুঝতে পরেছি এই ঢুলি পল্লীটিকে নিয়ে কাজ করেছিকিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রধান এই উৎসটিকে আমরা মূল্য দেইনি । আমরা সহসাই অনাগ্রহ দেখিয়েছি। আমরা চাইলে খুব অল্প খরচে এই পল্লীটিকে একটি গ্রামীণ সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে পারি।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফজলে রাব্বি বলেন, বর্তমান সরকার সংস্কৃতিবান্ধব সরকার । উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পিছিয়ে পড়া এই ঢুলি সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করছে । ঢুলি পল্লীর সদস্যরা চাইলে তাদের নিজস্ব জমিতে পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করার সুযোগ আছে। পাশাপাশি তাদের সরকারি অনুদান সহ খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সুবিবেচনায় রাখবে উপজেলা প্রশাসন। আমরা এ ব্যাপারে আন্তরিক।