সাইফুল ইসলাম
আমরা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত,জাফলং কিংবা বিছানাকান্দিতে বেড়াতে গেলে সেখানে দীর্ঘক্ষণ গোসল করে সময়টাকে উপভোগ করার চেষ্টা করি।পানিতে থাকার এই সময়টা ৫ মিনিট বা তার চেয়েও বেশিক্ষণ ধরে হয়ে থাকলে আমাদের হাতে পায়ের তালু ও আঙ্গুলে এক ধরনের অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
আমাদের তালু ও আঙ্গুলের চামড়া এমনভাবে কুঁচকে যায়,মনে হয় আমরা বৃদ্ধ হয়ে গেছি।এ ধরনের ঘটনা তখনই ঘটে যখন আমরা আমাদের হাত-পা পানিতে অনেকক্ষণ ধরে ভিজিয়ে রাখি।অবশ্য পানি থেকে উঠার পর তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
প্রশ্ন হল এর কারণ কী?
যদি উত্তর হতো ‘অভিস্রবণ’ এর কারণেই এই ঘটনাটি ঘটে, তাহলে এখানে বিস্ময়ের কিছু থাকে না।আসল রহস্যে যাওয়ার আগে অভিস্রবণ দিয়ে ব্যাখ্যা করার ব্যপারটি আলোচনা করা যাক।অভিস্রবণ হল কোন অর্ধভেদ্য ঝিল্লীর ভেতর দিয়ে নিম্ন ঘনত্বের দ্রবণ থেকে উচ্চ ঘনত্বের দ্রবণে পানির প্রবাহ।
অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষন পানিতে থাকার ফলে আমাদের আঙ্গুল ও তালুর ত্বকে এ প্রক্রিয়ায় বাইরে থেকে পানি ভেতরে প্রবেশ করে।কারণ আমাদের ত্বকের বাইরের অংশটি অর্ধভেদ্য।এর ভেতরে যে লবণের দ্রবণ আছে তা বাইরের পানি থেকে অধিক ঘনত্ব বিশিষ্ট।অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় তাই বাইরে থেকে পানি অধিক ঘনত্বের কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করে।ফলে ত্বকের বাইরের অংশটি পানি শোষণ করে প্রসারিত হয়ে যায়।কিন্তু ভেতরের অংশের কোন পরিবর্তন না ঘটায় কেবল বাইরের অংশের এ প্রসারণ দেখলে কুঁচকে গেছে বলে মনে হয়।মজার ব্যপার হল ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এ ঘটনাকে অভিস্রবণ দিয়েই ব্যাখা করতো।
কিন্তু পরে একটি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে ঘটনাটির পেছনে অভিস্রবণ দায়ী নয়!
বিজ্ঞানীরা প্রত্যক্ষ করে দেখলেন যে হাতের আঙ্গুলের স্নায়ু অকেজো এমন কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এ ব্যপারটি ঘটে না!অথচ অভিস্রবণ দায়ী হলে তা কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই সবার ক্ষেত্রে ঘটার কথা।
বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার জন্য এমন এক ব্যক্তিকে বাছাই করলেন যার হাতের তিনটি আঙ্গুল এর স্নায়ু অকেজো ছিলো।তার সেই হাত পানিতে অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রাখার পর দেখা গেলো চামড়া কুঁচকে যায় নি!
তার মানে বুঝা গেলো এ ঘটনার সাথে আমাদের মস্তিষ্ক ও ত্বকের স্নায়ুকোষ জড়িত।অর্থাৎ পানিতে নামলে কোন কারণে আমাদের মস্তিষ্ক স্নায়ুর মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটার নির্দেশ প্রদান করে।
ব্যপারটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা যাক।আমাদের আঙ্গুলের ত্বকে অনেকগুলো স্তর আছে।সব স্তরেই গ্রন্থি,রক্তবাহিকা কিংবা লোমকূপ থাকেনা।
প্রধানত আমাদের ত্বক এপিডার্মিস, ডার্মিস ও হাইপোডার্মিস এ তিনটি স্তরে বিভক্ত।সবচেয়ে বাইরের পাতলা স্তরটিকে এপিডার্মিস বলে।এর পরের স্তরটিকে ডার্মিস এবং সবচেয়ে গভীরের স্তরটিকে হাইপোডার্মিস বলে।
সবচেয়ে বাইরের পাতলা স্তর এপিডার্মিসে কোন স্নায়ুকোষ ও রক্তনালী থাকে না।কিন্তু মাধ্যস্তর ডার্মিসে স্নায়ুকোষ,ঘর্মগ্রন্থি এবং রক্ত চলাচলের জন্য রক্তবাহিকা থাকে।রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহের ফলে যখন বাহিকাগুলো ফুলে থাকে তখন আমাদের ত্বক টান টান থাকে।
কিন্তু পানিতে দীর্ঘক্ষন থাকলে ডার্মিসের ঘর্মগ্রন্থিতে পানি প্রবেশ করতে থাকে। ফলে সেখানে উপস্থিত লবণ এর দ্রবণ ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে। তখন দ্রবণে সমতা রক্ষার্থে মস্তিষ্ক সেখানের স্নায়ুকোষের মাধ্যমে রক্তবাহিকাগুলোকে সংকুচিত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে।এর অর্থ হল এতোক্ষন এই ডার্মিস স্তরের রক্তবাহিকাগুলো ফুলে এপিডার্মিসের সাথে লেগে স্তরটিকে টানটান করে রেখেছিলো।কিন্তু স্নায়ুকোষের হস্তক্ষেপ এর প্রভাবে এখন তা সংকুচিত হওয়ার দরুন এপিডার্মিস থেকে অনেকটা আলাদা হয়ে যায়।এ কারণে এপিডার্মিস স্তরটি আর টান টান থাকার সুযোগ নেই।তাই বেচারা কুঁচকে যেতে বাধ্য হয়।
পানিতে ভেজানোর সাথে সাথে ঘটনাটি ঘটে না কারণ আমাদের ত্বকে ‘সেরেবাম’ নামক একপ্রকার তৈলাক্ত প্রলেপ থাকে। এই সেরেবাম শুরুতে ত্বকে পানি প্রবেশে বাধা প্রদান করে।কিন্তু পানিতে অনেকক্ষন থাকলে ত্বক থেকে সেরেবাম একসময় দূর হয়ে যায়। তখন ডার্মিস এর ঘর্মগ্রন্থিতে পানি প্রবেশের পথ সুগম হয়।
কেবল হাত ও পা ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও এ কুঞ্চন না ঘটার প্রধান কারণ আমাদের হাত পায়ের ত্বকের মতো আর কোথাও এতো বেশি রক্তবাহিকা থাকেনা।
এখন প্রশ্ন হলো পুরো ঘটনাটি স্নায়ুর সাথে সম্পর্কিত কেনো?
এর উত্তর হল বিবর্তন।অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষদের যখন পানিতে খাদ্য সংগ্রহ কিংবা অন্য প্রয়োজনীয় কারণে দীর্ঘক্ষন পানিতে থাকতে হতো,তখন ত্বকের এ সংকোচন তাদের ঐ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করতো।
যেমন তারা যেকোন পিচ্ছিল বস্তু ত্বকের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কুঞ্চিত অবস্থায় সহজেই ধরে ফেলতে পারতো।পানিতে ভেজা পিচ্ছিল পথ তারা পূর্বের চেয়ে ত্বকের কুঞ্চিত অবস্থায় সহজে অতিক্রম করতে পারতো (গাড়ির অমসৃণ টায়ার যেভাবে বৃষ্টিস্নাত পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে)। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে পানিতে পিচ্ছিল কোন বস্তুকে আঁকড়ে ধরতে কুঁচকে যাওয়া হাতের ক্ষমতা অকুঞ্চিত হাতের চেয়ে ১০% বেশি!
প্রশ্ন জাগতে পারে হাতে ও পায়ে এই কুঞ্চন সবসময় থাকে না কেনো?
খেয়াল করে দেখবেন পানিতে থাকার ফলে যখন এ কুঞ্চনের ঘটনাটি ঘটে, তখন সেখানে আমাদের অনুভূতি অনেকাংশে হ্রাস পায়।এই অনুভূতি হ্রাসের ফল অন্যান্য স্বাভাবিক কাজগুলো করার সময় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই কেবল পানিতে অনেকক্ষন কাজ করার প্রয়োজনে হাত পা কুঁচকে যাওয়ার জন্য স্নায়ুগুলো সজাগ হয়ে উঠে।
এখন থেকে পানিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার পর নিজের হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষনিক বুড়ো হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে হতাশ না হয়ে বরং উপভোগ করুন।পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করুন।
সাইফুল ইসলাম
প্রভাষক
রসায়ন বিভাগ
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ