সাইফুল ইসলাম:
মুরব্বিদের প্রায়ই বলতে দেখবেন “ওমুক ছেলেটিকে মাত্র সেদিন হাফপ্যান্ট পরতে দেখেছি, এখন কত্তো বড়ো হয়ে গেছে”! আর এদিকে সেই ছেলেটিই আবার বলে বেড়াচ্ছে “কবে বড়ো হবো? কবে? এতো পড়াশোনা আর ভালো লাগে না।”
কিংবা আমাদের সবারই ছোটবেলার একটি সাধারণ স্মৃতির কথা মনে করে দেখুন; একটি ঈদ যাওয়ার পর আরেকটি ঈদের জন্য যখন অপেক্ষা করতাম, মনে হতো যেনো অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করে চলেছি।
স্কুল জীবনে গ্রীষ্মের আম কাঠালের ছুটিতে যখন মামার বাড়ি বেড়াতে যেতাম, মন ভরে আনন্দ করতে করতে একসময় মনে হতো আর বোধহয় স্কুলে যাওয়া লাগবে না। মাস্টার মশাইগন মনে হয় স্কুল ও ক্লাসের কথা ভুলেই গেছেন! আর এখন বড়ো হওয়ার পর দেখছি চোখের পলকেই যেনো দিনগুলো চলে যাচ্ছে। এইতো সেদিন বিসিএস দিয়ে চাকুরীতে যোগদান করলাম, অথচ সময়ের স্রোতে আড়াই বছর হাওয়া হয়ে গেলো!
এখন প্রশ্ন হলো বয়স বৃদ্ধির সাথে সময়ের গতি আদৌও বাড়ে কিনা? বাড়লে তার দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? বিশ্বাস করুন এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি প্রতিনিয়ত ভাবি। কারণ আমার প্রতিদিন মনে হয় সময় এতো দ্রুত চলে যাচ্ছে যে, আমি মনে হয় স্মরণীয় কিছুই করে যেতে পারবো না। সময়ের সাথে আমি যেনো প্রতিনিয়ত ইদুর-বেড়াল খেলে যাচ্ছি! জীবনে পাওয়া না পাওয়া ও কি করলাম আর না করলাম তার হিসেব নিকেষ চলে আসার আগে, চলুন তার একটি বিশদ বৈজ্ঞানিক আলোচনায় যাওয়া যাক।
প্রথমেই বলে রাখি ‘সময়’ পরম নয়। এটা আপেক্ষিক।আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কল্যাণে আমরা জেনে গেছি ‘সময়’ বস্তুর গতি ও গ্রাভিটি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর মানে হল আপনার চেয়ে অধিক গতিশীল একজন ব্যাক্তির সাথে আপনার সময়ের পার্থক্য থাকবে। কিংবা পাহাড়ের চুড়ায় বাস করা আপনার বন্ধুটির সাথে সমতলে বসবাস করা আপনার সাথে সময়ের হেরফের থাকবেই।
কিন্তু বয়সের সাথে সময়ের গতি প্রভাবিত হয় কিনা? এর উত্তর হলো ‘হয়’।
সেটা জানার আগে আরেকটু বলে রাখি, যান্ত্রিক ঘড়ি ছাড়াও আরেকটি ঘড়ি আছে যেটা হল মনের ঘড়ি। এই ঘড়ি কাজ করে মস্তিষ্কের উপলব্ধির (Perception of Time) মাধ্যমে। এই মনের ঘড়ির অস্তিত্ব আইন্সটাইনের একটি রসিকতার মধ্যেও পাওয়া যায়।
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কারের পর আইন্সটাইনের নাম তখন পৃথিবীব্যপী ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র কয়েকজন বিজ্ঞানী ছাড়া বেশিরভাগ মানুষের কাছে তত্ত্বটি ছিলো অতি দুর্বোধ্য।তাই এক সাংবাদিক আইন্সটাইনকে বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ করলেন।
আইন্সটাইন তার ব্যাখ্যা করলেন এভাবে,”যখন আপনার প্রেমিকার সাথে দু’ঘন্টা ডেটিং করবেন, আপনার কাছে তখন দু’ঘন্টাকে মনে হবে মাত্র এক মিনিট! আর যখন এক মিনিট একটি উত্তপ্ত চুলার কাছে বসে থাকবেন, তখন ঐ এক মিনিটকেই মনে হবে দু’ঘন্টা! এটাই সময়ের আপেক্ষিকতা।”
যাইহোক বয়সের ক্ষেত্রে আসল সময়ের গতির কোন হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এই মনের ঘড়ি অর্থাৎ মস্তিষ্কের Perception of Time এর দৈর্ঘ্যের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে।এর প্রকৃত বৈজ্ঞানিক কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে থাকলেও বেশ কয়েকটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে।
এক. আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য গ্রহণ ও ধারণ করে।এই তথ্যগুলো গ্রহণ ও ধারণের মুহুর্তে তাকে একটি প্রক্রিয়াকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।এর জন্য মস্তিষ্ককে সময় নিতে হয়।
যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন সবকিছুই আমাদের কাছে নতুন ছিলো।তাই মস্তিষ্ক নতুন নতুন তথ্য গ্রহণ করেছে।এই তথ্য ধারণ এর সময় তা প্রোসেস করতে সময় লেগেছে। তাই আমাদের শৈশবে সময় ধীরগতিতে চলে।
কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের চারপাশের জগৎ মস্তিষ্কের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে। তাই নতুন কোন তথ্য আর ধারণ করার প্রয়োজন পড়ে না। তাই মস্তিষ্ককে ততোটা সময় ব্যয় করতে হয় না।
এ জন্যই বয়স বাড়ার সাথে আমাদের সময়ের গতি বাড়তে থাকে।
খেয়াল করে দেখবেন, আমরা কোন অপরিচিত জায়গায় গেলে যাওয়ার সময় যতোটা দীর্ঘ মনে হয়, আসার সময় ততোটা দীর্ঘ মনে হয় না। কারন যাওয়ার সময় মস্তিষ্ক অচেনা সব কিছু নতুন মনে করে তথ্য ধারণ করেছে, কিন্তু আসার সময় সবকিছু পরিচিত ছিলো তাই সময় কম মনে হয়েছে।
দুই. আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের Metabolism এর হার কমতে থাকে। Metabolism হল শরীরে সংঘটিত সকল ধরনের রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়া যা প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য। এই Metabolism কমে যাওয়ার সাথে আমাদের হৃদস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাস কমে যায়।তাই বয়সের সাথে সময়ের গতিও কমে যাওয়ার এটাই কারণ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের হৃদস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাস বেশি হওয়ার ফলে সময়ের ইন্টারভাল দ্রুত হয় যা মস্তিষ্কের Perception of Time কে শ্লথ করে দেয়। তাই শিশুদের সময় ধীরগতির হয়।
তিন. আমাদের Perception of Time লগারিদমিক স্কেল অনুসরণ করে।অর্থাৎ এই স্কেলে একটি মান থেকে পরবর্তী মান সাধারণ লিনিয়ার স্কেলের মতো হয় না। লগারিদমিক স্কেলে বিশাল পার্থক্য থাকে। ভুমিকম্পের রিখটার স্কেলও তেমনি লগারিদমিক স্কেল।
যাইহোক, এখন যা ব্যাখ্যা করবো, তা যদি অনুধাবন করতে পারেন, তাহলে সত্যিই আজ থেকে আপনাকে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ব্যাপারটি রহিম-করিম দুই ভাইয়ের উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করবো।
ধরুন, রহিমের বয়স ২ বছর। তার মানে তার পুরো জীবনটাই মাত্র ২ বছরের। সে হিসেবে তার জন্য এক বছর হল জীবনের ৫০% অর্থাৎ তার পুরো জীবনের অর্ধেক!
এর মানে হল তাকে পরের জন্মদিনের জন্য তার জীবনের আরো অর্ধেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। মস্তিষ্কের Perception of Time ঠিক এভাবেই কাজ করবে।
এবার ধরুন, রহিমের বড় ভাই করিমের বয়স ১০ বছর। তার জন্য এক বছর হলো তার জীবনের ১০%। তার মানে দাঁড়ালো করিমের এক বছর যে গতিতে চলবে রহিমের এক বছর তার চেয়েও ২÷১০= ৫ গুন ধীরগতিতে চলবে। শুধু করিমের বয়স বেশি হওয়ার ফলে তার সময় কতো দ্রুত যাচ্ছে একবার ভাবুন!
আবার মনে করুন রহিম ও করিমের দাদা সলিম এর বয়স ৫০ বছর। সেক্ষেত্রে তার একবছর হলো তার পুরো জীবনের ২%। এর অর্থ হল তার বয়স করিমের চেয়ে ২ ÷ ১০ = ৫ গুন এবং সবচেয়ে ছোট রহিমের চেয়ে ২ ÷ ৫০ = ২৫ গুন দ্রুত গতিতে চলবে!
এর মানে আমাদের বয়স যতোই বাড়ছে, Perception of Time লগারিদমিক স্কেলে তার গতি বেড়েই চলেছে।
এখন ৩০ বছরের কেউ যদি মনে করে থাকেন “মাত্র তো ৩০ বছর গেলো,আরো তো অর্ধেক সময় হাতে আছে।ততোদিনে কাজগুলো গুছিয়ে নিবো।”
আদৌও কি আপনার হাতে ৩০ বছর থাকবে? অবশ্যই না।
তবে হ্যাঁ,যান্ত্রিক ঘড়ি হয়তো আপনাকে ৩০ বছরের কথাই বলবে কিন্তু আপনার মনের ঘড়ি Perception of Time হিসেব করে জীবনকে কতোটা সংক্ষিপ্ত করে দেবে টেরই পাবেন না।
তাই আপনার বয়সের যেই প্রান্তেই আছেন, সত্যিকারের Time এর বদলে Perception of Time নিয়ে ভাবুন। নিজের পরিবারের ও দেশের জন্য কতটুকু করতে পেরেছেন আর কতটুকু বাকি রেখেছেন তার হিসেব নিকেষ এখনই শুরু করে দিন।
সবকিছুর পরে যে অবধারিত অনন্ত জীবনকে বরণ করতে যাচ্ছেন, সেখানে কতোটা তৃপ্তি নিয়ে যেতে পারবেন সেটাও ভাবুন।
জানেনই তো লালন বলেছেন “সময় গেলে সাধন হবে না”।
প্রভাষক – রসায়ন বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ