অবৈধ ডলার লেনদেনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ নওগাঁর নাহিদ!
1 min readনিজস্ব প্রতিবেদক, নওগাঁ :
নেই কোনো কাজ, কর্ম কিংবা চাকুরী। ছিলো না কোনো ব্যবসা। কোনো কিছু না থাকলেও হঠাৎ করেই বনে গেছেন বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক। যখন ইচ্ছে কিনছেন নতুন মোটরসাইকেল, করছেন বাড়ি। আবার টাকার গরমে বউ পছন্দ না হলেও মোটা অংকের বিনিময়ে পুরনো বউ ছেড়ে দিয়ে ঘরে এনেছে নতুন বউ। এমনি এক অভিযোগ রয়েছে ২৮ বছরের এক যুবকের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত ওই যুবক নওগাঁ সদর উপজেলার ৩নং বক্তারপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের গোলাম হোসেন এর ছেলে নাহিদ হোসেন।
সম্প্রতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া নাহিদকে নিয়ে এলাকায় চলছে জল্পনা-কল্পনা। কোনো কিছু না করেই সম্পদের অভাব নেই তার, এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে এতো পরিবর্তন? স্থানীয়রা হাসির ছলে বলেই বসছে, আলাদিনের প্রদীপ পেলেই এতো সম্পদ অর্জন সম্ভব।
তবে, অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা, অনলাইনে অবৈধ ডলার ব্যবসায় সহ বিদেশি ভার্চুয়াল ব্যাংকে ডলার লেনদেন ও বিদেশি ব্যাংক-ক্যাশ অ্যাপ সাপোর্ট দেওয়ার মাধ্যমে অল্প সময়ে এতো পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে নাহিদ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত তিন বছর আগেও কিছু না থাকলেও বর্তমানে বাড়ি, গাড়িসহ নগদ টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন নাহিদ। কয়েক বছর আগে তার বাবা গোলাম দিন মজুরি কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতো। নাহিদের দাদারও ছিল না তেমন কোনো সহায় সম্পদ বা নগদ অর্থ। তাই পারিবারিক সূত্রেও পায়নি তেমন কিছু। স্থানীয়রা বলছেন, পুরোপুরি বেকার ছিল নাহিদ। কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে নাহিদ এখন কোটিপতি স্টাইলে চলাফেরা করছেন। আর তার এমন পরিবর্তন দেখে হতবাক স্থানীয়রা।
করে না কোনো কর্ম বা চাকুরী। নেই কোনো ব্যবসা। অথচ তার এখন সম্পদের অভাব নেই, এতো তাড়াতাড়ি তার এমন পরিবর্তন নিয়ে এলাকায় চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
এদিকে, বক্তারপুর (চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে) গ্রামে গেলো বছর নির্মাণ করা বাড়ি পছন্দ না হওয়ায় তা ভেঙে পাঁচ তালা বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করছেন। এছাড়া শ্যামপুর গ্রামে তার নানার বাড়ির এলাকায় কিনেছে বেশ কছিু ফসলি জমি। ব্যবহার করছে আর ওয়ান ৫ আপডেট ভার্সনের মোটরসাইকেল। আছে দেড়’শ সিসির পালসার গাড়িও। আছে কয়েকটি নামি-দামি মোবাইল ফোন। বানিয়েছে কয়েক ভরিস্বর্ণও। স্থানীয় রবিউল নামের এক স্বর্ণকারের কাছে সে স্বর্ণের কাজ করিয়েছেন। স্বর্ণ বানানোর সত্যতা নিশ্চিত করে কারিগর রবিউল বলেন, আমরা তো আর দোকানদার নই, তাই কি পরিমাণ সে স্বর্ণ বানিয়েছে তার হিসেব দিতে পারবো না। তবে সে আমার কাছে ভালো ওজনের স্বর্ণ বানিয়েছে।
সূত্রমতে, গত ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নাহিদ। তবে ওই সংসার টিকেনি বেশিদিন। মাত্র কয়েক মাস সংসার করে শিফা খাতুন নামের ওই গৃহবধুকে তালাক দেয় নাহিদ। কেন তালাক দেয় এমন প্রশ্নে শিফা জানান, আমার কোনো দোষ ছিলোনা। আমি তার চোখে দেখতে অসুন্দর, সেজন্য আমাকে বিনা কারণে তালাক দিয়েছে নাহিদ। বলা যায় আমাকে জোর করে তালাক দিয়েছে সে। সেসময় আমি ছিলাম অসহায়। আমার নিজের বলতে তেমন কেউ ছিলোনা এবং থানায় গেলেও কেউ কিছু করতে পারবে না বলেও আমাকে ভয় দেখিয়ে ছিলো নাহিদ। বলতে গেলে আমি এতিম। পরে গত বছরের জুলাই মাসে ভালো পরিমাণ নগদ অর্থ (১০লাখ টাকা ও ৫ ভরি) স্বর্ণ তাকে দেওয়া হয়। তবে জানা যায়, শিফাকে তালাক দিয়ে গত ২০২৩ সালের ৭ জুলাই মুন নামের এক মেয়েকে ২য় বিয়ে করে নাহিদ।
সম্প্রতি, চাকলা স্কুল মোড়ে দোকান ভাড়া নিয়ে নায্য মূল্য চাল ঘর নামে প্রতিষ্ঠান দিয়েছে নাহিদ। সেখানে তার বাবাকে বসতে দেখা যায়। তবে অনেকেই বলছেন, অবৈধ সম্পদের তথ্য যেন ফাঁস না হয় এবং মানুষের মনে সন্দেহ না জন্মায়, দায় এড়ানোর জন্য দোকানটি দিয়েছে নাহিদ। নাহিদের বাবা পড়াশোনা না জানলেও দিয়ে রেখেছেন দামি পিসি ও মনিটর। এলাকাবাসী বলছেন, দোকান দিয়েছে সেটা শুধু মানুষকে বোকা বানানোর জন্য, যাতে মানুষ বুঝে সে ব্যবসায় করে। আসলে তার অবৈধ সম্পদ আড়াল করতে কৌশল অবলম্বন করেছে । তার বাবা সহজ সরল এবং বয়স্ক। সেজন্য দোকানে তাকে বসিয়ে রেখে সে অবৈধভাবে অনলাইনে কাজ করে সে।
একাধিক স্থানীয় সচেতন ব্যক্তি জানান, নাহিদ অন-লাইনে স্কিপ্টু কারেন্সি, জুয়া, অবৈধ ডলার লেনদেন, ক্যাশ-অ্যাপ সাপোর্ট ইত্যাদির সাথে জড়িত বলে আমরা শুনতে পেরেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভ্যানচালক বলেন, নেটে কি ব্যান খেলে নাহিদ। লেখাপড়া করতে করতে আঙুল ফুলে কলা গাছ। কিছুদিন আগে ভাত পেলনা। এখন কিবা করে এসব করিচ্ছে। এটা কি হকের টাকা। এটা কিন্তু হকের টাকা না।
স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, পূর্বে তাদের পারিবারিক অবস্থান ভালো ছিল না। নাহিদের দাদা এবং গোলাম হোসেনের বাবা রাইস মিলের ড্রাইভার ছিল। সে পৈত্রিকভাবে কোনো সম্পত্তি বা নগদ তেমন অর্থ পায়নি। শোনা যায়, নেটে কি যেন করে নাহিদ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আগের বউয়ের কোনো দোষ ছিল না, তারপরও টাকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তাকে কিছু করতেও দেখিনি। এখন যে দোকান দিয়েছে সেটা লোক দেখানো শো হিসেবে।
তার নানার বাড়ি শ্যামপুর এলাকার একজন বৃদ্ধ বলেন, কিছুদিন আগে আমার বাড়ির পাশে কয়েক শতক জমি কিনেছে নাহিদ। এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে এতো টাকা ইনকাম করছে সে সেটা সত্যিই রহস্যজনক।
আরেক মুরুব্বি একইভাবে বলেন, মোবাইলের মাধ্যমে ডলার ভাঙাচুরা করে নাহিদ। বৈধ পথে এতো তাড়াতাড়ি কোনোভাবেই সম্ভব না এভাবে সম্পদের মালিক হওয়া। এছাড়া নিজের বাড়ির পাশাপাশি মামার বাড়ির বড়-বড় অনুষ্ঠানে নাহিদই খরচ করে। শুনেছি তার মায়ের নামেই অনেক গুলো ব্যাংকে একাউন্ট করে রেখেছে সে। নিজের নামে তো আছেই। এগুলো অতি শীঘ্রই জব্দ করা হোক ও তার প্রতিটি ব্যাংক একাউন্ট নজরদারি করা হোক, এটাই আমাদের দাবি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশে যাতায়াতও করে। এত টাকার মালিক হওয়া বৈধভাবে কখনোই সম্ভব নয়।
স্থানীয় এক ফ্রিলান্সারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি, সে অবৈধ ডলার লেনদেন, ক্যাশ-আপ সাপোর্ট, সিপিএ মার্কেটিং এগুলোর সাথে জড়িত। গত দুই-তিন বছরের মধ্যে প্রভাবশালী হওয়ায় তার ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। তবে তার মায়ের নামে বেশিরভাগ ব্যাংক একাউন্ট খোলা এবং ভালোভাবে তদারকি করলে তার অবৈধ সম্পদ সব বের হবে। এছাড়া যদি কেউ ফিল্যান্সার হয়, তাহলে বাংলাদেশী যে কোন ব্যাংকের মাধ্যমে আয়কৃত রেমিটেন্স তার একাউন্টে নিয়ে আসতে পারবে। ব্যাংকে ডুয়েল কারেন্সি একাউন্ট থাকতে হবে। এছাড়া রেমিটেন্স গ্রহণ করার জন্য যাবতীয় তার বৈধ কাগজপত্র ব্যাংক কৃর্তক জমা নিয়ে তাকে একটি একাউন্ট করে নিতে হবে। সে যদি প্রকৃতপক্ষে ফ্রিল্যান্সার হয় আইডি কার্ডের জন্য আইসিটি মন্ত্রনালয়ে আবেদন করতে হবে। তার পর আইডি গ্রহণ করে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে স্বীকৃতি নিতে হবে।
নাহিদের সেই দোকানের ব্যানারে তার মোবাইল নাম্বার প্রথমে দিলেও সরিয়ে নিয়ে পাশের দোকান ভাই ভাই কম্পিউটার এন্ড স্টুডিওর মালিক জাহিদ রানার মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে। তার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, জাহিদও নাহিদের সাথে অনলাইনের এসব অবৈধ কাজে জড়িত এবং কিছু মাস আগে প্রায়ই জাহিদের দোকানে রাত্রি যাপন করে তাদের সে কাজগুলো পরিচালনা করেছে নাহিদ। জনমনে সন্দেহ সৃষ্টির পর সেখানে আর তাদের রাত্রিযাপন করতে দেখা যায়নি।
ইদানিং, নাহিদ তার ২য় স্ত্রী মুন, শাশুড়ি, শ্বশুর সহ আরো কয়েকজন সাথে নিয়ে মাঝে মাঝে রাজশাহী শহরের একটি অভিজাত ফ্লাটে থাকেন বলেও জানা গেছে।
নানান অভিযোগের বিষয়ে এড়িয়ে গিয়ে মুঠোফোনে নাহিদ বলেন, আমার প্রথম স্ত্রী থাকাকালীন দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবার কাছে থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। যে কারণে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি। অনলাইনে যে ডলার লেন-দেন করছেন, সেটা কি বৈধভাবে করছেন কিনা এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, সেটা দেখার জন্য প্রশাসন আছে আপনি কে? বলেই ফোনের সংযোগ কেটে দেয়।
নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) গাজিউর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার অবৈধ লেন-দেন হলে তা অবশ্যই অপরাধ। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।