ভোরের জানালা

জনগণের কল্যাণে অগ্রদূত

অপারেশন জটিলতায় প্রসূতির মৃত্যু; লাপাত্তা চিকিৎসক!

1 min read
  • দেবিদ্বারে ব্যাঙের ছাড়ার মতো গড়ে ওঠা হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে হরহামেশাই ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
  • নেই প্রশাসনের নজরদারী!

মেহেদী হাসান রিয়াদ :

কুমিল্লার দেবিদ্বার মর্ডাণ হাসপাতালে সিজার পরবর্তী জটিলতায় নাদিয়া নামে এক প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৩ মার্চ বুধবার দিবাগত রাতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার সময় রোগীর মৃত্যু হয়। এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে গাইনী সার্জন ডা. নীলা পারভীন, ডা. মাইদুল ইসলাম এবং ডা. সাজ্জাদুল আলম ওই প্রসূতির সিজার সম্পন্ন করেন। এদিকে গত ১২ মার্চ ডা. নীলা পারভীন এর বিরুদ্ধে “দেবিদ্বারে গাইনী সার্জনের বিরুদ্ধে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অ্যানেসথেসিস্ট ছাড়াই অজ্ঞান করার অভিযোগ” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ওই প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

নাদিয়া আক্তার (১৮) উপজেলার গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের মধুমুড়া পূর্বপাড়া গ্রামের মোঃ নুরুল ইসলাম এর মেয়ে এবং সুবিল ইউনিয়নের খাইয়ার গ্রামের খাইরুল আলম (প্রবাসী) এর স্ত্রী।

হাসপাতাল ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সিজার সম্পন্ন হয় নাদিয়ার। তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক হলে হাসপাতালের ২০৯নং বেড এ নেওয়া হয় তাকে। এরপর রাত সারে আটটা নাগাদ বমি ও খিচুনি দিতে থাকে নাদিয়া। বিষয়টি সাথে সাথেই আবাসিক ডাক্তার এটিএম সাজ্জাদুল আলম চৌধুরীকে জানান নাদিয়ার পরিবার। এসময় নাদিয়ার অস্ত্রোপচারের জায়গা থেকে রক্তক্ষরণও হয় বলে জানায় তার পরিবার।

এদিকে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে রোগীর প্রেসার কমে পালস রেকর্ড করতে পারছিলেন না হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সাজ্জাদুল আলম চৌধুরী। রোগীর অবস্থা আশংকাজন হতে থাকলে সার্জন ডা. নীলা পারভীন এর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালায়। তবে সিজার শেষ করে ডাক্তার নীলা পারভীন অজ্ঞাত কারণে উধাও হয়ে যায়। এমনকি তার সাথে সাথে অ্যানেসথেসিস্টকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় জীবন রক্ষাকারী ইনজেকশনগুলোও পুষ করা হয়। তাতেও রোগীর প্রেসার রেকর্ডেবল না হওয়া এবং পালস খুঁজে না পেয়ে রোগীকে ডোপামিন দিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।

অনুসন্ধানে জানাযায়, গাইনী সার্জন ডা. নীলা পারভীন এর নিয়মিত নিভীর পর্যবেক্ষণে ছিলেন প্রসূতি নাদিয়া আক্তার। ডা. নীলা পারভীন এর তত্বাবধানে থাকা অবস্থায় নাদিয়া আক্তারের সকল মেডিকেল রিপোর্ট হাতে আসলে বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন গাইনী বিশেষজ্ঞ ও সার্জন এর সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। সেখানে থাকা আট্রস্নোগ্রাফি রিপোর্ট অনুযায়ী নাদিয়া আক্তারের স্বাভাবিক ডেলিভারী ডেইট এ মাসের ২৩ তারিখ। রক্ত পরিক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী তার শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিনও ছিলো স্বাভাবিক। এছাড়া তার শারীরিক ভাবো কোনো প্রকার সমস্যাও লক্ষ্য করা যায়নি রিপোর্টগুলোতে।

মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী প্রসূতি নাদিয়া আক্তার এর এমন কোনো কারণই ছিলো না যার কারণে তাকে সিজার করানো লাগতে পারে। তাহলে ডেলিভারী ডেইট এর ১০ দিন আগে কেন রোগীকে সিজার করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে এক বিশেষজ্ঞ জানান, মেডিকেল রিপোর্ট গুলো পর্যালোচনা করে এমন কোনো কারণই পাওয়া যায়নি, যার কারণে রোগীকে ১০দিন আগে সিজার করানো প্রয়োজন হলো। যেখানে ডা. নীলা পারভীন নিজেই ওই রোগীকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতেন।

এদিকে অনুসন্ধান চলাকালে “দেবিদ্বারে গাইনী সার্জনের বিরুদ্ধে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অ্যানেসথেসিস্ট ছাড়াই অজ্ঞান করার অভিযোগ” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করার দুইদিন পর ১৪ মার্চ বাংলাদেশ সরকার এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মোঃ মহিউদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে (স্বারক নং-বিঃপ্রঃস্বঃচঃ/৪-১/প্রশা-২০২৪/৩১৩৭) ০৭ জন সরকারি কর্মকর্তাকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উল্লেখিত পদ ও কর্মস্থলে সাময়িক কাজ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। প্রজ্ঞাপনের ক্রমিক নং ০৭ এ কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলাধীন মাধবপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এর সহকারী সার্জনডা. নীলা পারভীন (কোড নং- ১২৩১২৯)কে মেডিকেল অফিসার পদে উল্লেখ করে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসনচর ২০ শয্যা হাসপাতালে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, এই আদেশ জনস্বার্থে জারী করা হলো এবং আদেশ জারীর তারিখ হতে ০৩ কর্মদিবসের মধ্যে সাময়িক ভাবে কাজ করার আদেশাধীন কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে অন্যথায় চতুর্থ দিন মূল কর্মস্থল হতে সরাসরি অব্যহতি পেয়েছেন বলে গন্য হবে।

প্রসূতি নাদিয়ার পরিবার সরাসরি আইনগত কোনো ব্যবস্থা না নিলেও সিজারের পর নাদিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের অবহেলার বিষয়টি ইঙ্গিক করেছেন। নিহতের বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, নাদিয়া গর্বধারনের পর থেকে নিরব তত্বাবধানে থেকে ১২মার্চ বিকেলে সিজার করান ডা. নীলা পারভীন। সিজারের পর ঘন্টা দুয়েক খুব ভালো থাকলেও রাত সাড়ে ০৮টা নাগাদ নাদিয়ার তল পেটে খুব ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। এসময় তার কিছুটা রক্তক্ষরণও হয়েছে। এছাড়া তার প্রেসার কমতে থাকার কারণে শরীরে খিচুনি আসতে থাকে। পরে সেখানে থাকা মেডিকেল অফিসার প্রাথমিক চিকিৎসা করতে থাকেন এবং সার্জন নীলা পরভীন এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। মেডিকেল অফিসার ডা. সাজ্জাদুল আলম এর ফোন রিসিভ না করায় নাদিয়ার মামা এবং মর্ডাণ হাসপাতালের ডাইরেক্টর খসরু নিজে বারংবার নীলা পারভীনকে ফোন দিলেও সে ফোন রিসিভ করেনি। পরে ডা. সাজ্জাদুল বাইরে থেকে একজন চিকিৎসক ফোন করে ডেকে আনেন। সব শেষ রাত সাড়ে ১১টার দিকে দেবিদ্বার মর্ডাণ হাসপাতাল থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হলে কুমিল্লা যাওয়ার পথে প্রসূতি নাদিয়া আক্তার মৃত্যুবরণ করেন।

বিষয়টির স্বচ্ছতা জানতে একাধিকবার ডা. নীলা পারভীনকে ফোন করা হলেও তার সাথে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

এবিষয়ে দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ আলী এহসান বলেন, ঘটনার পর আমরা মর্ডাণ হাসপাতালে তদন্ত করেছি। তদন্ত রিপোর্ট কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সিভিল সার্জন পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

এদিকে সংবাদ সংগ্রহ এবং অনুসন্ধান চলাকালে প্রতিবেদকের কাছে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী পরিচয়ে একজন ফোন দিয়ে সংবাদ না প্রকাশ করতে রফাদফা করার চেষ্টা চালায় এবং প্রতিবেদকের নামে মিথ্যে সংবাদ সম্মেলন করারও হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া রোগীর পরিবারে পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো প্রকার অভিযোগ দায়ের না করার কারণে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে কিছুটা বিলম্ব হওয়া পাঠকের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেছেন তিনি।

Please follow and like us:
স্বত্ব © ২০২৪ ভোরের জানালা | Developed by VJ IT.
Translate »